সুনামগঞ্জে শিশু অপরাধে আবারও যুগান্তকারি রায়

প্রকাশিত: ৭:২৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ২১, ২০২২ | আপডেট: ৭:২৫:অপরাহ্ণ, মার্চ ২১, ২০২২

 

মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী, সুনামগঞ্জ ব্যুরো প্রধান:

সুনামগঞ্জে শিশু অপরাধের ৫০টি মামলায় ৭০ শিশুকে অভিভাবকের জিম্মায় ৯টি শর্তে সংশোধনের সুযোগ দিয়ে রায় দিয়েছেন আদালত। সোমবার (২১ মার্চ) দুপুর সোয়া ১২টায় সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জাকির হোসেন এ ব্যতিক্রমী রায় প্রদান করেন।

এসময় সুনামগঞ্জ শিশু আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) হাসান মাহবুব সাদী, জেষ্ঠ্য আইনজীবী আফতাব উদ্দিন, আইনুল ইসলাম বাবলু, শেরে নূর আলী, সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী সিনিয়র ও জুনিয়র আইজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

এজলাশ কক্ষে বিচারক বলেন, কোমলমতি এসব শিশুদেরকে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে মামলায় জড়ানো হয়েছিল যাদের বিরুদ্ধে মারামারিতে জড়িত এবং ছোট খাট কিছু চুরির অভিযোগ আনা হয়েছিল। ক্ষুদ্র একটি অভিযোগে এসব শিশুদের আদালতে হাজিরা দিতে হত। এর ফলে শিশুদের ভবিষ্যত এক অনিশ্চিয়তার মধ্যে নিপতিত হয়। তাদের শিক্ষাজীবন ব্যহত হয়। স্বাভাবিক জীবনে শিশুদের বেড়ে ওঠা হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে ছিল। শিশুদেরকে এসব অসুবিধা থেকে মুক্তি দিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিতে এবং সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে মামলা সমূহ দ্রæত নিস্পত্তি করা হল। কারাগারের পরিবর্তে এ ৭০ শিশুকে পরিবারের সদস্যদের সাথে রেখে সংশোধনের জন্য তাদের বাবা,মায় ও অভিভাবকের জিম্মায় দেয়া হল। পরিবারের সান্নিধ্যে এসব কোমলমতি শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠতে এবং সুন্দর জীবন গঠনের সুযোগ পাবে। এসব শিশুদের জীবনকে আরও সুন্দরভাবে গড়ার জন্য বিচারক ৯টি শর্তাবলী পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।

শর্তগুলো হল, নিয়মিত পড়াশুনার পাশাপাশি প্রতিদিন কিছু ভাল কাজ করা এবং ডায়রীতে তা লিখে রাখা, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা, সবার সাথে সদ্ভাব রাখা এবং ভাল ব্যবহার করা, বাবা-মাসহ গুরুজনদের আদেশ নির্দেশ মেনে চলা এবং বাবা মায়ের সেবা যতœ করা ও কাজে কর্মে তাদের সাহায্য করা, নিয়মিত ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা এবং ধর্মকর্ম পালন করা, প্রত্যেকে কমপক্ষে ২০টি করে গাছ লাগানো এবং গাছের পরিচর্যা করা, অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা, মাদক থেকে দূরে থাকা এবং ভবিষ্যতে কোন অপরাধের সাথে নিজেকে না জড়ানো।

জেলার দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ সুরিয়ারপাড় গ্রামের সামছুদ্দিনের ছেলে সিলেটের বিশ^নাথ উপজেলার দৌলতপুর ইসলামিয়া দুরুলছুন্নাহ হাফিজিয়া মাদ্রাসার হিফজ শাখার ছাত্র ইসলাম উদ্দিন জানায়, এক বছর আগে গ্রামে প্রতিপক্ষের সঙ্গে মারামারি ঘটনা ঘটে। তিনি ওই মারামারির ঘটনাসম্পর্কে কিছুই জানে না। তবুও তাকে ওই মারামারির মামলায় আসামি করা হয়েছে। ইসলাম উদ্দিন আরও জানায়, ওই মামলায় কতজন আসামি বা কে বাদী এটাও জানেন না। আদালতের সমন পেয়ে গত এক বছর ধরে সুনামগঞ্জে এসে আদালতে নিময়মিত হাজিরা দিচ্ছে। এতে পড়া-লেখায় ব্যকঘাত হচ্ছিল। আজ বিচারক ৯টি শর্ত দিয়ে তাকে বাবা মায়ের জিম্মায় দেয়া হয়। এতে তার পড়া-লেখা সে পড়া-লেখায় মনোযোগ দিতে পারবে। একই বক্তব্য অপর মারামারি মামলার শিশু অভিযুক্ত সদর উপজেলার রঙ্গারচর গ্রামের মুক্তার আলীর ছেলে নবী হোসেনের । নবী হোসেন জানায়, এক বছর আগে গ্রামের মারামারির মামলায় তাকেসহ তার পক্ষের ৪জন শিশুকে মামলার আসামি করা হয়। অপর আসমিরা হচ্ছে, সজিব, আজিজুল। সজিব ও আজিজুল এবার একাদশে ভর্তি হয়েছে।

জেলা প্রবেশন অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম জানান, আদালত আজ ৫০টি মামলায় ৭০ জন শিশু অপরাধীকে ৯টি শর্তে বাবা, মা ও অভিভাবকের জিম্মায় সাজা ভোগের নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশে আদালতকর্মীরা ৭০ জন অভিযুক্ত শিশুর হাতে ডায়েরি, কলম, ফুল ও জাতীয় পতাকা তোলে দিয়েছে। শিশুরা প্রতিদিন আদালতের নির্দেশিত কর্মকাÐ ওই ডায়েরিতে লিখে রাখবে। প্রবেশন কর্মকর্তা আরও জানান, তিন মাস অন্তর অন্তর তিনি ওই ৭০ শিশুর কর্মকাÐ আদালতে পেশ করবেন। এক বছর আদালতের নির্দেশনা মতো এসব শিশুরা কাজকর্ম করলে তাদের মামলা নিষ্পত্তি হবে।
প্রসঙ্গত, একই আদালতের একই বিচারক গত বছরের ১৩ অক্টোবর ৫০ মামলায় ৭০ শিশু অভিযুক্তকে সংশোধনের জন্য অভিভাবকের জিম্মায় দেন। ২০২০ সালে ১৪ অক্টোবর ১০ মামলায় ১৪ শিশুকে সংশোধনের জন্য অভিবাবকদের জিম্মায় সাজা ভোগের রায় দেন। এছাড়ও ওই বিচারক গত মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) ৫০ মামলায় ৫০ দম্পতিকে আপোষে নিষ্পত্তি করেন। একইভাবে গত বছরের ২২ ফেব্রæয়ারি একই ধরনে মামলায় আদালতের উদ্যোগে ৫৪ সংসার জোড়া লাগে। এর আগে ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর ওই আদালতে ৪৭টি মামলায় ৪৬টি পরিবার নিজেরে ভুলবুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আবার সংসার জীবনের প্রবেশ করে।