মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী, সুনামগঞ্জ :
যা-ই কিছু হয়, তাই কাঁচা ধান কাটতেছি। যদি কিছু না-ই হয়। গুরুর তো খোরাক হবে। অর্থাৎ কাঁচা ধান কেটে যে-টাই পাওয়া যায়। যদি ধান কিছুটা না-ই পাওয়া যায়। গরুর খাবার তো হবে। এই উক্তিটি জেলার নবগঠিত মধ্যনগর উপজেলার বিরেন্দ্র নগর গ্রামের কৃষক কামরুল হাসানের।
কামরাল জানান, মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) দিনগত রাত রাঙামাটি হাওরের বাধ ভেঙ্গে হাওরের ফসল তালিয়ে যাওয়ায় পানিতে নেমে ধান কাটছেন। এ ধান যদি নিজের জন্য কাজে না লাগে তবে গরুর খাবারতো হবে। এই আশায় তিনি ধান কাটছেন। তিনি জানান, এবার প্রায় ৮ একর বোরো জমি চাষাবাদ করেছেন। এখন পাহাড়ী ঢলে বাঁধ ভেঙ্গে হাওর তলিয়ে গেছে। তাই পানিতে নেমে কাঁচা ধান কাটছেন। একই বক্তব্য বাঙ্গালভিটা গ্রামের কৃষক চান মিয়ার।
এ উপজেলার বংশীকুন্ডা ইউনিয়নের চেয়ারম্যা নূর নবী তালুকদার জানান, রাঙামাটিয়া হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে ও উপচে তলিয়ে গেছে হাওরের একশত হেক্টর জমির বোরো ধান। তিনি আরো জানান, এ হাওরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন প্রকল্প নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কৃষকদের উদ্যোগে বাঁধগুলো বাঁধা হয়েছিল। ইউপি চেয়ারম্যান জানান, গত ১০দিন ধরে হাওরের ফসল রক্ষার জন্য কৃষকদের নিয়ে চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হলো না। ইউপি চেয়ারম্যান নূর নবী তালুকদার আরো জানান, গত ২ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত তার ইউনিয়নের প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমির কাঁচা ধান তরিয়ে গেছে।
এদিকে, জেলা জগন্নাথপুর উপজেলার একটি ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধ উপচে নদীর পানি হাওরে ঢুকে পড়ায় দুটি হাওরের ৮০০ একর জমির বোরোধান তলিয়ে গেছে। এ উপজেলার অন্যান্য হাওরের ফসলও রয়েছে ঝুকির মধ্যে।
অপরদিকে,শান্তিগঞ্জ উপজেলার পূর্বপাগলা ও দরগাপাশা ইউনিয়নের কাঁচিভাঙ্গা হাওরে ছয়হাড়া গ্রামের দক্ষিণ পাশের নিরক্ষা আফার দিয়ে পানি ঢুকে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর বোর ফসল তলিয়ে গেছে।
দিরাই উপজেলার ধনচানপুর গ্রামের নাজিম উদ্দিন জানান, উপজেলার বরাম হাওরে তিনি এবার চাষ করেছেন ৩ একর। কিন্তু ধান কাঁচা থাকায় কাটতে পারছেন না। একই হাওরের কৃষক আনাছুর রহমান জানান, তিনি ২০ একর জমি চাষ করেছেন। নদ-নদীর পানি বৃদ্দি পাওয়ায় আধাপাকা কিছু ধান কটেছেন। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, এ পর্যন্ত ৫হাজার ৬৩৫ হেক্টর জমি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। কিন্তু কৃষক নেতারা দাবি করছেন কমপক্ষে ১০ হাজার হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে ঢলে পানিতে। এবার জেলার ১২টি উপজেলায় ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমি চাষাবাদ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) পর্যন্ত জেলায় ৭২ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। যা শতকরা ৪৩ হবে বললেও কৃষক নেতারা তা মানতে নারাজ। হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব চিত্তরঞ্জন তালুকদার মানবকণ্ঠকে জানান, কৃষি বিভাগ ৪৩ শতাংশ ধান কাটার যে পরিসংখ্যান দিয়েছে। সেটা কাটার অর্থে । কিন্তু কৃষক তো কাঁচা ধান কেটেছে। তাদের গোলায় তো আর ৪৩ শতাংশ ধান উঠবে না। কারণ কৃষকরা ধান কেটেছে যাই পাওয়া যায় এবং গুরুর খাবারের জন্য।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে কুদরত পাশা জানান, এ পর্যন্ত ২০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে। তিনি কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যানকে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, এ পর্যন্ত ৩০ ভাগ ধানও পাকেনি। কৃষকরা যা-ই কেটেছে নিজের মনকে বোঝাতে এবং গরুর খাবার হিসেবে কেটেছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র , বাপাউবো, ঢাকা হতে প্রাপ্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাত ও আকষ্মিক বন্যা সম্পর্কিত বিশেষ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডে সিলেট অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী এস এম শাহীদুল ইসলাম এক ক্ষুতে বার্তায় মানবকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম (বরাক অববাহিকা) এবং মেঘালয় প্রদেশের স্থানসমূহে চলতি সপ্তাহে ১৯ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামগ্রিক ভাবে মাঝারি বৃষ্টিপাত সংঘটিত হতে পারে। তবে ২০-২১ এপ্রিল দেশের অভ্যন্তরে এবং উজানের কতিপয় স্থানে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯ থেকে ২৫ এপ্রিল কালীন সময়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট জেলার সুরমা, কুশিয়ারা, সারিগোয়াইন, ধলাগাং, পিয়াইন, লুভাছড়া নদীসমূহের পানি সমতল সামগ্রিকভাবে হ্রাস পেতে পারে এবং সুনামগঞ্জ জেলার সুরমা, যদুকাটা, ঝালুখালি নদীসমূহের পানি সমতল সামগ্রিকভাবে কিছুটা ধীর গতিতে হ্রাস পেতে পারে। অপরদিকে, নেত্রকোণা জেলার সোমেশ্বরী, ভুগাই কংস, ধনু-বাউলাই নদীসমূহের পানি সমতল সপ্তাহের প্রথমার্ধে স্থিতিশীল থেকে দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সামগ্রিকভাবে হ্রাস পেতে পারে। তবে ২০ ২১ এপ্রিল মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের প্রেক্ষিতে নদীসমূহের পানি সমতল কতিপয় স্থানে সময়বিশেষে বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার কতিপয় স্থানে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি/অবনতি হতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডে এই প্রকৌশলী আরো জানান, সুরম নদীর পানি নামছে না। একারণ সুনামগঞ্জে ধেয়ে আসা ঢলের পানি মেঘনায় নামতে পারছে না। এ পানির প্রবাহ মিঠামইনের বাউলাই নদী থামিয়ে দিচ্ছে। এ কারণে ২৪ ঘণ্টায় সুরমা নদীর চার হাজার কিউসেক পানির মধ্যে মাত্র এক হাজার কিউসেক পানি মেঘনা নদীতে নামতে পারছে। অবশিষ্ট ৩ হাজার কিউসেক পানি হাওরে প্রবেশে চাপ সৃষ্টি করছে। এতে হাওর রক্ষা বাঁধের ওপর অস্বাভাবিক প্রভাব পড়ছে।
বাঁধ দুর্নীতিবাজদের বিচার হবে : জাহিদ ফারুক : পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেছেন, বাঁধ দুর্নীতিবাজদের বিচার হবে। আমরা চাই দোষী ব্যক্তির শাস্তি হোক। তাই হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের ব্যপারে ঢালাওভাবে অভিযোগ না করে আমাদের সঠিক তথ্য দেন।
বুধবার (২০ এপ্রিল) সকালে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার হাওর এলাকা পরিদর্শনে যাওয়ার আগে সুনামগঞ্জ রিভারভিউয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ২০১৭ সালে যারা হাওরের দুর্নীতি করেছিলো আমরা ৮ জন প্রকৌশলীকে কিন্তু সাসপেন্ড (বরখাস্ত) করা হয়েছে। তারা এখনও সাসপেন্ড রয়েছে দুদকে মামলা হয়েছে। তাই হাওরের ধান রক্ষায় বাঁধে দুর্নীতিবাজদের আগেও বিচার হয়েছে এবারও হবে। এখনও যদি কেউ জড়িত তাকে তাহলে তাকেও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হবে।
তিনি বলেন, হাওরের ধান রক্ষায় সরকার সব সময় কৃষকের পক্ষে কোটি কোটি টাকা দিয়ে থাকে তাহলে সেই টাকার কাজ হয়েছে কি না হয়নি সেটি দেখতে হবে। আমরা এখানে সততার সাথে কাজ করার চেষ্টা করছি । আমরা ও আপনারা সবাই মিলে একসাথে কাজ করব। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, পানি উন্নয়ন বোর্ডর সিলেট অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহীদুল ইসলাম, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন প্রমুখ।