মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার জনপ্রিয় হোমিও চিকিৎসক, সাম্যবাদী দলের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. পবন চন্দ্র দেবনাথের ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হলো ৫ জুলাই শুক্রবার। তাঁর গ্রামের বাড়ি বনগাঁও-২ গ্রামে পারিবারিক নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। ওইদিন সন্ধ্যার পরে কলকাতার কমরেড রবিন পাত্র আর ঢাকা থেকে আগত কমরেড হাসান মাসুদ ডা. পবন চন্দ্র দেবনাথের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মালা পরিয়ে দেন।
নিজ গ্রাম আর মফস্বল শহরের গণ্ডি পেরিয়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়া ডা. পবন চন্দ্র দেবনাথ ছিলেন আপাদমস্তক একজন শ্রেণিসংগ্রামের মানুষ। শ্রমিক-কৃষক খেটে খাওয়া জনপদে বিপ্লবী স্পৃহা-চেতনা তৈরিতে তাঁর ছিলো অবাধ বিচরণ। বহুমাত্রিক চিন্তা-চেতনার পুরোধা এই পুরুষ কুলাউড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে উঠেও নিজের বিপ্লবী চিন্তা, আপোসহীন মনোভাব ও সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন সর্বত্র। হৃদয়ে আজন্ম ধারণ করেছিলেন চীনের কৃষি ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের তাৎপর্য। মানুষের জন্য পরিবর্তন নয়, রূপান্তরের মধ্য দিয়েই সমাজ পাল্টানোর ভাব-মানসের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সৃজনশীল কর্মে। মেজর (অব.) এম এ মোত্তালিব রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধের উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গন’ বইয়ের একটি জায়গায় ডা. পবন চন্দ্র দেবনাথের নাম স্বীকৃতিস্বরূপ উল্লেখ আছে। ডা. পবন চন্দ্র দেবনাথ শিক্ষক, কবি ও সাংবাদিক সঞ্জয় দেবনাথের বাবা। ১৯৯১ সালের ৫ জুলাই ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ডা. পবন চন্দ্র দেবনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র ডা. বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ (বাবুল) এর বাবা সম্পর্কে স্মৃতিচারণমূলক লিখা-
১৯৩৬ এ জন্ম নেওয়া ডা. পবন চন্দ্র দেবনাথের রাজনৈতিক হাতে কড়ি ৫০ এর দশক এর গোড়ার দিক থেকে রাউৎগাঁও স্কুলে এন্ট্রাস পড়া অবস্থায়। হিঙ্গাজিয়া গ্রাম নিবাসী ড. বিজন বিহারী পুরকায়স্থের হাত ধরে। ড. বিজন বিহারী পুরকায়স্থ ভারতে চলে যান। কমিউনিস্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি উনি ছিলেন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ও ডিন। অবসরের পর তিনি তিনবার বাংলাদেশ সফর করেন। উঠেছিলেন আমাদের বাসায় উত্তর বাজার কুলাউড়ায়। মূলত ডা. পবন চন্দ্র দেবনাথ ১৯৬২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। রাজনৈতিক কারণে পরিবার থেকে সরে থাকতেন বেশিরভাগ সময়। উনার জীবন মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিলো। যা পরবর্তীতে আমি বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করবো।
১) রাজনৈতিক, ২) সাংস্কৃতিক ও নাট্য, ৩) হোমিও গবেষণা পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠাসমূহ।
উনার কর্মময় জীবনের রাজনীতির পাশাপাশি দলিল লেখক, সহকারী সরপঞ্চ, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যসহ সামাজিক কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন। উনার কর্মক্ষেত্র এত ব্যাপক ছিলো যে স্বল্প পরিসরে বলা মুশকিল। ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকারের সামরিক শাসন চলছে ডা. পবন চন্দ্র তখন ধানমন্ডী, ঢাকা-১৯৭, গ্রীণ রোড (বর্তমান কলাবাগান থানা) হোমিও প্র্যাকটিস এর পাশাপাশি সাম্যবাদী দলের সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ। চাপ আসে সরকার থেকে, আসে গোয়েন্দা নরজদারি চেম্বারের উপর। রোগী সেজে আসতেন সামরিক কর্মকর্তারাও। আসতেন বুদ্ধিজীবী সমাজ, উল্লেখ না করলে নয় চেম্বারে আসতেন সাবেক মন্ত্রী বি.এম আব্বাস, জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী, ড. হামিদউল্লা খান, ড. এস এম লুৎফুর রহমান। পরিশেষে আসে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল মান্নান সিদ্দিকীর পক্ষ থেকে প্রস্তাব। এরশাদ সাহেব পাঠিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করার জন্য। ডা. পবন চন্দ্র দেবনাথ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর গোয়েন্দাদের অতিরিক্ত চাপের কারণে স্ট্রোক করে দেড় মাস পিজি হাসপাতাল বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ছিলেন। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী বি.এম আব্বাস সাহেব দেখা করতে গেলেন। উনারা পবন বাবুর চিকিৎসার ত্রুটি দেখে দেখা করলেন তৎকালীন পিজি হাসপাতালের মহাপরিচালক ডা. নুরুল ইসলাম সাহেবের সাথে। সরকারি খরচে ডা. পবন বাবুর চিকিৎসার দাবি জানানো হয়, এগিয়ে আসলেন কমরেড দিলীপ বড়ুয়া। গঠিত হয় মেডিকেল টিম। সরকারি খরচায় এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন। ৫ জুলাই, ১৯৯১ সকল কর্মের অবসান ঘটিয়ে অকালে চলে গেলেন ডা. পবন চন্দ্র দেবনাথ।