(পূর্ব প্রকাশের পর)
শুরুতেই যে কথাটি বলা দরকার তাহলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রথম থেকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু ছাত্রনেতা তথা বিশেষ করে তারিক আলী পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন বলে পাকিস্তান কমিউনিটির মুখে মুখে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরে তারিক আলী এবং তজাম্মেল টনি হকের নাম ছিল ।তাছাড়া ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ তথা বিশেষ করে আব্দুস সবুর চৌধূরী,আজিজুল হক ভূঁইয়া,মহিউদ্দিন আহমেদ,মোস্তাফিজুর রহমান,ইসমাইল আজাদ,মোহাম্মদ ইসরাইল,গনেশ দে,সেলিম আহমদ,কাজী শফিকুল হক,খলিলুর রহমান,নুরুজ্জামান খান,সাবান মিয়া,আসক আলী,আব্দুল হান্নান,মতছিম আলী,আলী আকবরসহ অন্যান্যরা শুরু থেকে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নেয়।
এই কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় মার্চের শুরুতেই বার্মিংহাম থেকে কোচযোগে লন্ডন গিয়ে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান হাইকমিশনে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী সম্বলিত স্মারক লিপি হস্তান্তর করে বাহিরে এসে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা জ্বালানো এবং সেই সাথে ইয়াহিয়া খানের কুশপুত্তলিকা দাহ করে বিবিসি টেলিভিশন ও অন্যান্য মিডিয়ার উপস্থিতিতে ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে পাকিস্তানের সাথে আমাদের সকল প্রকার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা হলো এবং সেই সাথে আরো ঘোষণা করা হলো যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানিদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে না ততদিন পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে । তা ছাড়া ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রান্ট তাঁদের কার্যক্রমকে গতিশীল এবং প্রচারের জন্য ঐ সময় ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রান্টের মুখপত্র হিসেবে “বিদ্রোহী বাংলা” নামে বার্মিংহাম থেকে একটি পাক্ষিক পত্রিকা বের করেন । যার যৌথ সম্পাদনায় ছিলেন সেলিম আহমদ ও মোস্তাফিজুর রহমান দীপু। ইউসুফ চৌধূরী ও ইসমাইল আজাদ ছিলেন অবৈতনিক ফটোগ্রাফার ।
“বিদ্রোহী বাংলা” প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল একাত্তর সালের ৪ঠা জানুয়ারী । হাতের লিখা পত্রিকাটি ২৯৭মি.মি.দ্ধ ৪২০মি.মি.সাইজের চারপৃষ্টায় প্রকাশিত হয়। বিদ্রোহী বাংলার দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয় একাত্তরের ৭ই মার্চ। প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের পর বিদ্রোহী বাংলার প্রকাশনার সাথে আরো যুক্ত হন জগলুল পাশা,মিসেস বদরুন নেছা পাশা,মহিউদ্দিন আহমদ প্রমূখ। যাঁর ফলে বিদ্রোহী বাংলার গুনগত মান আরো সমৃদ্ধ হয়। বিদ্রোহী বাংলার তৃতীয় সংখ্যার সম্পাদকীয়তে ছিল” আপোষ না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম” । সে সময় ‘বিদ্রোহী বাংলা’ নানা তাজা খবরের মধ্য দিয়ে সবাইকে আন্দোলনের দিকে ঝুকতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। যেমন “অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে এসেছে এক গন বিপ্লবের জয়- জয়কার”। এ গন বিপ্লব শুধু বাংলাদেশ আর পাকিস্তান নয়,সমগ্র ভারত এবং দূর-প্রাচ্য গনবিপ্লবের এক নতুন অধ্যায় আখ্যায়িত করার চেষ্টা করা হয়। যাতে করে শ্রেণী শক্রুদের নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হয়।
বিদ্রোহী বাংলা’ও প্রতিটি শিরোনাম ও প্রতিবেদনে ছিল বিদ্রোহের ডাক। প্রতিবেদনগুলো এ রকম ছিল যে,গবঃৎড়ঢ়ড়ষরঃধহ চড়ষরপব সূত্রে জানা যায় যে,ইংল্যান্ডের ইতিহাসে অশেতাঙ্গদের এত বড় মিছিল ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। আনুমানিক দশ হাজারের অধিক বাঙালীর এই মিছিল প্রমান করে দিলো,সূদুর পাঁচ হাজার মাইলের ব্যবধানে ও জন্মভূমি বাংলাদেশের ডাকে বাঙালীরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে সাড়া দিয়েছে। এ ছাড়া বিদ্রোহী বাংলায় অনেক আবেগপ্রবন শিরোনাম ছিল,তন্মধ্যে একটি ছিলো “সবুজ বাংলা লাল হলো”। বিদ্রোহী বাংলার প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সংখ্যার পর এই পত্রিকায় যোগদান করেন,বাংলাদেশের স্বাধীনতা কামী এবং বাঙালী স¤প্রদায়ের অকৃত্রিম বন্ধু তৎকালীন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজ ছাত্র মিঃ রজার গুইন (বাঙালীরা ভালোবেসে ডাকতেন রাজা মিয়া)। যাঁর চমৎকার হাতের লিখা সংবাদ ও প্রতিবেদন সমৃদ্ধ হয়ে আরো আকর্ষণীয় হয়ে প্রকাশ হতে থাকে। ‘বিদ্রোহী বাংলা ‘র খবর সংগ্রহের জন্য নিজস্ব কোন সোর্স না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো আসতো ভারতীয় দূতাবাসের থার্ড সেক্রেটারী ও পশ্চিমা সাংবাদিকদের কাছ থেকে। তবে ভারতের ভি,পি,ধরের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। বিদ্রোহী বাংলা’য় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ,যুক্তরাজ্যের বাঙালীদের বিভিন্ন কর্ম তৎপরতার খবর, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি, ও বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্ব এবং বাংলাদেশের হানাদার বাহিনীর গনহত্যার খবর প্রকাশ করা হতো। এ ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাকিস্থানী দূতাবাসে র্কমরত বাঙালীদের “মুজিব নগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের সংবাদগুলোও ফলাও করে প্রচার করা হতো।
চলবে—–।