বাংলা কাগজ ডেস্ক ঃ গুরু যার বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করীম; যে কোন সময়, যে কোন স্থানে, আপন মনে গান রচনা করে,সুর দিয়ে শ্রোতাদের মাতিয়ে তোলতে পারেন যিনি; ইতিমধ্যে প্রায় চারশত গান রচনা করে বৃটেনে এসে রেস্টুরেন্টের কায়িক শ্রম আর জীবন যুদ্ধের গøানি টেনেও সঙ্গীতের প্রতি হৃদিক টান আর অনুভূতির একটুও কমতি নেই যার মাঝে; নিপীড়িত-নির্যাতিত আর পোঁড় খাওয়া মানুষদের প্রকাশ করতে না পারা ব্যাথা আর বেদনার কথা ছন্দের মার্ধুয্যে-সুরের গাঁথুনিতে নিমেষেই ভূমিষ্ঠ করাতে পারেন যে মানুষটি তিনি হলেন, বার্মিংহামের সকলের প্রিয় মানুষ ফকির হারুনুর রশীদ (৫২)। বার্মিংহাম তথা বৃটেনের বাঙালিদের মধ্যে থেকেও একাধারে গান লিখা,সুর করা,আবার কণ্ঠের মার্ধুয্যে তা ধারন করতে পারেন এমন গানের মানুষ-প্রাণের মানুষ ২/১ জন খোঁজে পাওয়া যাবে কি না তা বলা মুষ্কিল। তবে বার্মিংহামের ফকির হারুনুর রশীদ তাদেরই একজন; যার মধ্যে এসব গুণাবলীর সব-ই বিদ্যমান। তিনি বাউল গানের এক বিরল প্রতিভা একথা বলা যায় নির্দ্বিধায়।
রেস্টুরেন্টে কাজ করা এই মানুষটি দেশে রেখে আসা প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখে স্বাবলম্বীতার হাসি, দুই ছেলে তিন মেয়ের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করতেই মূলতঃ বৃটেনে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ২০০৮ সালে ব্রিটেনে পাড়ি জমানো ফকির হারুনুর রশীদ এখনো পরিবারের সেই সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যই পড়ে আছেন ব্রিটেনে। প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে ব্রিটেনের সঙ্গীতপ্রিয় বাউল প্রিয় মানুষদের গান শুনিয়ে যাচ্ছেন তিনি তার আপন মহিমায়। এখনো তাঁর গান লিখা-গান গাওয়ার স্পৃহা এতোটুকু কমেনি। নানা প্রকিকূলতার মাঝে নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে কিভাবে গানকে ধারন আর সুরের মুর্চ্ছনায় মগ্ন থাকা যায় ফকির হারুনুর রশীদ তার এক উদাহরণ। জীবন যুদ্ধে তেমন সফল হতে না পারলেও গানের যুদ্ধের সৈনিক ফকির হারুনুর রশীদ বরাবরই গানেরই পাগল। ২০১৮ তে ‘‘হেরা চাপ্টির কোলে‘‘ একটি বইও লিখেছেন তিনি,যার মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন বার্মিংহামের তৎকালীন বাংলাদেশী সহকারী হাইকমিশনার নাজমুল হক।
সঙ্গীতের মানুষ হিসেবেই তিনি বৃটেনে এসেছেন, লাইভ অংশ নিয়েছেন বৃটেনের বাংলাভাষী বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে,দর্শকদের অনুরোধে গান গেয়েছেন বার্মিংহামের বাংলা মেলা,পিঠা মেলা,বিজয় মেলাসহ বড় বড় নানা অনুষ্টানে। যে কোনো অনুষ্টান নিয়ে তৎক্ষনাত গান রচনা করতে পারার বিরল প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটির জন্ম সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার জগদল গ্রামে। মরহুম আব্দুল আজিজ পীরের সাত ছেলে এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় ফকির হারুন রশীদের বাউল সঙ্গীতে হাতে খঁড়ি দিরাই’র জগদল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুধীন্দ্র বাবুর হাতে। পরে শিল্পী শফিকুন নূরের কাছ থেকে এবং শফিকুন নূরের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত শফিকুন নূর সঙ্গীতালয় থেকে দ্বীক্ষা নেন ফকির হারুনুর রশীদ। এরপর শাহ আলী নূর এবং তাঁর প্রধান গুরু বাউল সম্রাট আবদুল করীমের সংস্পর্শেই মূলতঃ বিকশিত হতে থাকে ফকির হারুনুর রশীদের প্রতিভা। যেখানেই যেতেন,সেখানেই তাঁর ¯েœহধন্য ফকির হারুনুর রশীদকে নিয়ে যেতেন শাহ আবদুল করীম। একই মঞ্চে গুরু-শিষ্য গান গাইতেন-শ্রোতাদের বাহ্বা কুড়াতেন। শাহ আবদুল করীমের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর বাড়ি উজানদল গ্রামে গান গাওয়ার স্মৃতিটাই ফকির হারুনুর রশীদের স্মৃতিতে আজো জ্বল জ্বল করে জ্বলে উঠে। সেখানেই হারুনুর রশীদের গানে মুগ্ধ হয়ে তাঁর গুরু বাউল সম্রাট শাহ আবদুর করীম তাকে ফকির উপাধি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এম.এ রউফ,সাবেক রাষ্ট্রপতি হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ,সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত,সিলেটের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান,জাতীয় রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ অনেকের সামনেই স্ব-রচিত বাউল গান গেয়ে বাহ্বা পেয়েছেন ফকির হারুনুর রশীদ। বিএনপি’র আমলে বৃহত্তর সিলেটের প্রায় সব শহরে আওয়ামী লীগের সরকার বিরোধী সমাবেশগুলোতে ফকির হারুনুর রশীদের বাউল গান উজ্জ্বীবিত করে রাখতো আন্দোলনকারী মানুষদের। সে সময় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা এবং বৃহত্তর সিলেটের আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে ফকির হারুনুর রশীদের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত ও সুর করা গান আজও মানুষের কানে বেজে উঠে। এখনো আওয়ামী লীগের নানা সভা-সমাবেশগুলোতে বাজানো হয় তার গানগুলো। ফকির হারুনুর রশীদ এখনো মনে করে উঠেন সুনামগঞ্জের এক জনসভায় গরীব-দুঃখীদের পক্ষে নেতা-মন্ত্রীদের সামনে কটাক্ষ করে গান গাওয়ার কারণে নেতা-মন্ত্রীরা তার গানকে কোড করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
ফকির হারুনুর রশীদ ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতেও গান করেছেনÑছিলেন বাংলাদেশ বেতার সিলেটের তালিকাভুক্ত শিল্পী। কিন্তু বৃটেনে আসার পর জীবন যুদ্ধের চাপে কিছুটা ভাঁটা পড়ে তার সঙ্গীত চর্চায়। কোন এক অনুষ্ঠানে তার সঙ্গীত প্রতিভা আর তাৎক্ষণিক গান রচনা করার ক্ষমতা দেখে মুদ্ধ হোন বার্মিংহাম বাংলাদেশ ইকোনমিক কাউন্সিলের কর্মকর্তা এনায়েত খান। পরে এনায়েত খান-মিছবাহ উদ্দিন-আব্দুল ওয়াহিদ প্রমুখরা উদ্যোগ নেন এই বাউল শিল্পীকে পুনরুজ্জীবিত করে তার প্রতিভাকে মানুষের সামনে তুলে ধরার। তারাই মুলতঃ তাকে নিয়ে আসেন কমিউনিটির সামনে। ফকির হারুনুর রশীদও বলেন, বৃটেনে এসে ভেবেছিলাম আমার আমিত্ব হারিয়ে যাবে, কিন্তু এখানকার কমিউনিটর মানুষদের ভালোবাসা সহযোগিতা এবং বাউল গানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণেই এখনো সঙ্গীতকে ছাড়তে পারিনি। তিনি বার্মিংহামের বাংলা গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, তৎকালীন সময়ে সিলেটের বাংলা গণমাধ্যমকর্মীদের উৎসাহ ও প্রেরণায়-ই আমি মুলতঃ আমার স্বরচিত গানগুলো সংগ্রহ করা শুরু করি। এর আগে যেখানে যেতাম শুধু গানই গাইতাম, সংগ্রহে রাখতাম না। বাংলাদেশের অনেক নামী-দামী ব্যাক্তির সামনে গান গাইলেও ফকির হারুনুর রশীদের স্বপ্ন দেশের সর্ব্বোচ্চ ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর সামনে একদিন বাউল গান পরিবেশনার।
অসংখ্য বাউল গানের রচয়িাত ফকির হারুনুর রশীদ বৃটেনে বাঙালি রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের নিয়েও বেশ কটি গান রচনা করেছেন। বাংলা কাগজের পাঠকদের জন্য তিনি নীচের গানটি রচনা করেছেন- তা হলো . . .
লন্ডন আইয়া ঠেকি গেছি গো. . .
লন্ডন আইয়া ঠেকি গেছি. . .
লাশ ঘরে থইয়াও কামে যাইতে হয়
শুক্র-শনিবারে
ভিজির সময় ভুল করিলে ঝাটার আঘাত পড়ে
তান্দুরীর আগুনে মুখ আর হাতে চামড়া পুড়ে;
পিঁয়াজ-আলু আর সিংগের ক্বামে জানো ধরাই লাইছি গো
লন্ডন আইয়া ঠেকি গেছি গো. . .
লন্ডন আইয়া ঠেকি গেছি. . .
কাম করিয়া ঘরে আইতে যদি দেরী অয়
বিষাক্ত কথাবার্তা যতো প্রাণে সয়
হুবার মারো,গোসল করো রাগ করিয়া বউয়ে কয়,
বেতন কই-কয় ধমক দিয়া-না দিলে কি আর বাঁচি গো. . লন্ডন আইয়া ঠেকি গেছি গো. . .
লন্ডন আইয়া ঠেকি গেছি. . .
দেশ থাকি মা-বোইনে যদি ফোন করে
দেশো টেকা দিবার লাগি ক্বিতা লন্ডন আনছিনি তোমারে
সারাটা রাইত খোঁচার ক্বতায় চোখের পানি ঝড়ে,
চান্দো যেমন ঘর নাই তরে অতো সুখে আছি গো
লন্ডন আইয়া ঠেকি গেছি গো. . .
লন্ডন আইয়া ঠেকি গেছি. . .
যারা ভাগ্যবান তারা পাইচে ভাগ্যমতি
মহাসুখে দেশ-বিদেশে করতেসে উন্নতি
সাফল্য জীবন তুলনায়,তাদের অনেক বেশি
সবার জীবন সুখের অউক রোজগার করক্কা বেশী বেশী
আলাহর কাছে ঐ মিনতি হারুনে করতেছি গো
লন্ডন আইয়া ঠেকি গেছি গো. . .
লন্ডন আইয়া ঠেকি গেছি. . . ।
সাধারণ মানুষদের নিয়ে তাঁর রচনা করা গানগুলো কোন একদিন হয়তো বৃটেন তথা বিশ্ব বাঙালিরা ধারণ করবে প্রাণের আনন্দেই। ফকির হারুনুর রশীদ তুমি এগিয়ে যাও দুর্জয়ভাবে মানুষের অগাধ ভালোবাসা নিয়ে আর আজীবন গেয়ে যাও জীবনের গান ; বাংলা কাগজের এই-ই প্রত্যাশা।