প্রমত্তা খরস্রোতা পদ্মা নদী। তার ওপর সেতু! এক দশক আগেও এই স্বপ্ন ছিল অকল্পণীয়। তবে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে জাতির। দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেদের অর্থায়নে তৈরি হওয়া এই সেতু এখন বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতার মূর্ত প্রতীক।
বাংলার ১৭ কোটি মানুষের স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুর কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে ৯৫ শতাংশ। আর পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক কাজ এগিয়েছে ৮৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সেতু চালু হলে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সড়ক পথে যুক্ত হবে দক্ষিণাঞ্চলেরর ২১ জেলা। তবে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম এ সেতু পার হতে লাগবে বড় অঙ্কের টোল।
সেতু বিভাগের নির্ধারণ করা টোলের হার নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার (২১ এপ্রিল) জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ফেরিতে পদ্মা নদী পার হতে যে টাকা লাগে, সেতু পার হতে এর চেয়ে গড়ে দেড় গুণ বেশি টাকা খরচ করতে হবে। আর দ্বিতীয় দীর্ঘতম বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলের সঙ্গে তুলনা করলে তা হবে প্রায় দ্বিগুণ। পদ্মা সেতুতে প্রস্তাবিত টোলহার কার্যকর হলে বড় বাসে ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং মাঝারি ট্রাকে লাগবে ২ হাজার ৮০০ টাকা।
এদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কর্মপরিকল্পনা অনুসারে, আগামী ৩০ জুনের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ঠিকাদারের। এর মধ্যে সেতু চালু হবে ধরে নিয়ে টোল আদায়কারী ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদার নিয়োগ করেছে সেতু বিভাগ। এই কাজ পেয়েছে কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন (কেইসি) ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। এর মধ্যে এমবিইসি বর্তমানে মূল সেতু নির্মাণকাজ এবং কেইসি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে।
আগামী ৫ বছরের জন্য এই দুটি প্রতিষ্ঠান টোল আদায়, সেতু ও সেতুর দুই প্রান্তে যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি চালু এবং সেতু ও নদীশাসনের কাজ রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এর জন্য ৫ বছরে তাদের দিতে হবে ৬৯৩ কোটি টাকা।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, টোল আদায়ের প্রস্তুতি নিতে এ মাসের শুরুর দিকে কেইসি ও এমবিইসিকে চিঠি দিয়েছে সেতু বিভাগ। সরকারি সংস্থাটি বলেছে, ৩০ জুনের মধ্যে পদ্মা সেতু চালু করার সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। ১ জুলাই থেকে টোল আদায় শুরু হতে পারে। সেভাবেই তাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। এই চিঠি পেয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টোল আদায়সংক্রান্ত সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার কিনতে দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন কোম্পানিকে ইতিমধ্যে ফরমাশ দিয়েছে।
সেতু বিভাগের যুগ্ম সচিব রাহিমা আক্তার বলেন, পদ্মা সেতুর টোলহার নিয়ে একটা প্রস্তাব তাঁরা তৈরি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য এ মাসে অথবা আগামী মাসে সারসংক্ষেপ পাঠানো হবে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, মাস ছয়েক আগে পদ্মা সেতুর জন্য টোলহারের ওই প্রস্তাব তৈরি করেছে সেতু বিভাগের একটি কমিটি। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই প্রজ্ঞাপন দেবে সেতু বিভাগ। খসড়া যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কমানোর সম্ভাবনা কম। প্রধানমন্ত্রী তা অনুমোদন দেবেন বলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন।
প্রস্তাবিত টোলহার: পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ভায়াডাক্ট (দুই প্রান্তের উড়ালপথ) ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ কিলোমিটার। বঙ্গবন্ধু সেতুতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর সময় টোলের হার ছিল বেশ কম। ২০১১ সালে এবং সর্বশেষ গত বছর টোল বাড়ানো হয়েছে। পদ্মা সেতুর প্রস্তাবিত টোলহার বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রায় দ্বিগুণ।
বর্তমানে পদ্মা নদী পার হতে ফেরিতে যানবাহনভেদে ভাড়া দিতে হয় ৭০ থেকে ৩ হাজার ৯৪০ টাকা। প্রস্তাব অনুসারে পদ্মা সেতুতে যানবাহনভেদে টোল দিতে হবে ১০০ থেকে ৬ হাজার টাকার বেশি। এর মধ্যে কার ও জিপের টোল ৭৫০ টাকা (ফেরিতে ৫০০ টাকা), বড় বাসে ২ হাজার ৪০০ টাকা (ফেরিতে ১ হাজার ৫৮০ টাকা), মাঝারি ট্রাকে ২ হাজার ৮০০ টাকা (ফেরিতে ১ হাজার ৮৫০ টাকা)। মালবাহী ট্রেইলারের (চার এক্সেল) ভাড়া ফেরিতে নির্ধারণ করা নেই। বঙ্গবন্ধু সেতুতে এই শ্রেণির ট্রেইলারের টোল তিন হাজার টাকা। পদ্মা সেতুতে তা ৬ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত টোলহার সেতু চালুর ১৫ বছরের জন্য প্রযোজ্য হবে। প্রতি ১৫ বছর পরপর টোলের হার ১০ শতাংশ করে বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
পদ্মা সেতু দিয়ে কত যানবাহন চলাচল করবে—এর পূর্বাভাস আগেই ঠিক করা হয়েছে। ওই পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২১ সালে সেতু চালুর হিসেবে দিনে প্রায় ৮ হাজার যানবাহন চলাচল করার কথা ছিল। ৩৫ বছর পর যানবাহনের সংখ্যা দিনে ৭১ হাজার ছাড়িয়ে যায়।