দেশে কর রাজস্ব বাড়ানোর জন্য ভ্যাট ও আয়কর আওতায় সম্প্রসারণ এবং দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের অনুপাত ৩৫:৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৭০:৩০ নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে সরকারি প্রণোদনার বাইরে নিয়ে আসা হচ্ছে বেসরকারি খাতকে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গঠিত ‘কর সংক্রান্ত বিধি-বিধান ও পদ্ধতি সংস্কার’ বিষয়ক স্টাডি গ্রুপের প্রাথমিক সুপারিশে এসব কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি এই সুপারিশগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপনা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সুপারিশে বলা হয়েছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাঠামোগত সংস্কার এবং করনীতি সংস্কারসহ সরকারি প্রণোদনা সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বেসরকারি খাতকে পর্যায়ক্রমে প্রণোদনার বাইরে নিয়ে আসতে হবে। এছাড়া কর ব্যয় সংক্রান্ত সমীক্ষা পরিচালনা, আয়কর ও মূসকের আওতা সম্প্রসারণ এবং করহার কমিয়ে রাজস্ব আয় বাড়াতে কৌশলগত ব্যবস্থা গ্রহণ, করযোগ্য বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আয়কর ও মূসকের আওতায় আনা হবে। কর ব্যয়ের অনুমান-প্রভাব ও প্রবণতা শনাক্ত করা এবং গণনা ও করভিত্তিক বিশ্লেষণে এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি, পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ের জন্য গত বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ ও শুল্ক যৌক্তিককরণ’ বিষয়ক একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। উপ-কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও কাস্টমস সংক্রান্ত বিধিবিধান ও পদ্ধতি সংস্কারবিষয়ক পর্যালোচনা করে একটি সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন প্রণয়নের লক্ষ্যে ৯ সদস্য বিশিষ্ট ‘স্টাডি গ্রুপ’ গঠন করা হয়। স্টাডি গ্রুপের ৫ দফা কার্যপরিধিও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, সমীক্ষা পরিচালনা শেষে স্টাডি গ্রুপ ৬ দফা প্রাথমিক সুপারিশ এবং ৫ দফা কার্যপরিধির আলোকে ২০ দফা সুপারিশ করে। এর মধ্যে কার্যপরিধি-১ (অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ জোরদারকরণে চলমান সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিতকরণ)-এর আওতায় ৫ দফা সুপারিশ রয়েছে।
কার্যপরিধি-২ (রাজস্ব প্রশাসনে ব্যবসাবান্ধব ও করদাতা সহায়ক প্রয়োজনীয় সংস্কারের ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিতকরণ)-এর আওতায় ৫ দফা সুপারিশ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন’ চুক্তির ২.১ ও ২.২ ধারা অনুযায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ক আইনকানুন ও বিধিমালার প্রস্তাবিত প্রবর্তন বা সংশোধনীর ওপর মতামত ব্যক্ত করা এবং অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ আরও সম্প্রসারণ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। রাজস্ব ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, নিরীক্ষা ও পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনায় যথাযথ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার বিধান অধিকতর নিশ্চিত করা। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে পদ্ধতিগত মাধ্যমে সহজ ও ত্বরান্বিত করা। করদাতা সেবা বাড়াতে অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ। সেবার পদ্ধতিগত ধাপগুলোকে আরও সহজ ও সময় সাশ্রয়ী করা।
জানা গেছে, কার্যপরিধি-৩ (আয়কর, মূল্য সংযোজন কর ও কাস্টমস সংক্রান্ত বিধিবিধান ও পদ্ধতি পর্যালোচনার জন্য একটি কর্ম-পরিকল্পনা নির্ধারণ)-এর আওতায় ৩ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-ইস্যুভিত্তিক গবেষণা-ট্যাক্স এক্সপেনডিচার এনালাইসিস, ট্যাক্স গ্যাপ এনালাইসিস, রেভিনিউ ফোরকাস্টিং, পার্সপেকটিভ এনালাইসিস অন আর্নিং স্ট্রাইপিং রুলস সম্পন্ন করা এবং আইনি প্রতিফলনে খসড়া তৈরি করা, আইন ও বিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনয়ন ও প্রশিক্ষণ দেওয়া।
কার্যপরিধি-৪ (স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ পরবর্তীতে কাস্টমস, মূসক ও আয়কর সংক্রান্ত যেসকল বিধি-বিধান ও পদ্ধতি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বিধানসমূহের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ থাকবে না, সেগুলো চিহ্নিতকরণ এবং প্রয়োজনীয় আইনি ও পদ্ধতিগত সংস্কারের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়ন)-এর আওতায় ৩ দফা সুপারিশ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-ডব্লিউটিও ও ডব্লিউসিও নিয়মের অধীনে কাস্টমস পদ্ধতিগুলো সুশৃঙ্খল, সহজ ও সরলীকরণ করা, আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক কাস্টমস প্রযোজ্যতার বিষয়টি পুনঃপরীক্ষা করা, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে এসব কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করে সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা।
কার্যপরিধি-৫ (কাস্টমস, মূসক ও আয়কর সংক্রান্ত যেসব বিধি-বিধান ও পদ্ধতি আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সেগুলো চিহ্নিতকরণ এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়ন)-এর আওতায় ৪ দফা সুপারিশ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-বাংলাদেশ ডিজিটাল ট্যাক্সেশনসহ নন-রেসিডেন্ট থেকে কর সংগ্রহে ভোক্তাকে ভিত্তি করে কর ধার্যের ভিত্তি রচনা করা এবং এ লক্ষ্যে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ ও প্রণীতব্য আয়কর আইনে প্রয়োজনীয় বিধান সংযোজনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। ক্যাশলেস অর্থনীতি এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিকাশ ত্বরান্বিত করা, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চাকে দেশীয় বাস্তবতায় প্রণয়ন করা। সবস্তরে একই মূসক হার ও রেয়াতি পদ্ধতি চালুর লক্ষ্যে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত-তা আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা এবং দেশীয় আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সাপেক্ষে পর্যালোচনা করা উল্লেখযোগ্য।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, এনবিআর এই সুপারিশ অর্থ মন্ত্রণালয়ে উপস্থাপন করেছে। এ বিষয়ে খুব শিগগির অংশীজনদের সাথে আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হবে।