বাজেট সহায়তা হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক ঋণ দাতা সংস্থাটিও এ ঋণ দেওয়ার আগে খুঁটিনাটি নানা বিষয় নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে কথা বলছে, সেই সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে নানা শর্ত। এরই অংশ হিসেবে ব্যাংকিং খাতে ঋণ পুনঃ তফসিলের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ, আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করতে বলেছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশে সফররত আইএমএফের প্রতিনিধিদলটি আগামী ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করবে। তাদের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করবে সংস্থাটির কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে কিনা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে,সংস্থাটি বলেছে ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য এ খাতের তথ্যের স্বচ্ছতা থাকা জরুরি। ব্যাংকিং খাতে প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের ঋণ যেভাবে রিসিডিউল বা পুনঃ তফসিল করা হয় তাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয় না। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ ধরনের স্বচ্ছতার বিশাল ঘাটতি রয়েছে। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উচিত এ বিষয়ে তৎপর হওয়া। আইএমএফের পক্ষ থেকে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা, সরকারি ব্যাংকে তহবিল সঞ্চিতি অনুপাত ঠিক রাখা, ব্যাংকিং খাতে সংস্কার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
গত সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় আইএমএফের পক্ষ থেকে এসব বিষয় তুলে ধরা হয় বলে সূত্র জানিয়েছে। আইএমএফের পক্ষে সভায় নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। অন্যদিকে, এফআইডি’র পক্ষে নেতৃত্ব দেন এই বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ।
বাজেট সহায়তা হিসেবে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে গত জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ, সে ব্যাপারে আলোচনা করতেই দলটি এখন ঢাকায় অবস্থান করছে। ২৬ অক্টোবর ২০২২ ঢাকায় এসেই ১০ সদস্যের এই প্রতিনিধিদলটি অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সভা করছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। তারা বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ঘাটতি ব্যাপক। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চায় আইএমএফ। এর জবাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকারও চায় ব্যাংকি খাতে সুশাসন নিশ্চিত হোক। এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সচেষ্ট রয়েছে। এ বিষয়ে প্রতি বছর ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ‘অ্যানুয়াল পারফরমেন্স এগ্রিমেন্ট (এপিএ)’ করা হয়। এই এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এক ধরনের টার্গেট দেওয়া হয়। যার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।
ঋণ পুনঃ তফসিল নিয়ে আইএমএফের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়। এ সময় এফআইডির পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক পুনঃ তফসিলের পরিসংখ্যান নিয়মিত প্রকাশ করে থাকে। আইএমএফ থেকে এ সময় বলা হয়, ঋণ পুনঃ তফসিলের তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয় তাতে পুনঃ তফসিলের অঙ্কটি পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা প্রকাশ করা হয় না। স্বচ্ছতা ও সুশাসনের জন্য এই তথ্য প্রকাশ করা জরুরি। এ বিষয়ে এফআইডির ভূমিকা পালনের কথা বলেছে আইএমএফ।আইএমএফের পক্ষ থেকে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র জানতে চাওয়া হয়। এফআইডির পক্ষ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। আইএমএফের পক্ষ থেকে খেলাপি ঋণের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বলা হয়, সরকার যে খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান দিচ্ছে, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও বেশি। এই খেলাপি ঋণের সঙ্গে আদালতে চলা খেলাপি ঋণ নিয়ে মামলা ও পুনঃ তফসিলকৃত ঋণের তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।
সভায় ব্যাংকি খাতের সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন তোলে আইএমএফ। এ বিষয়ে এফআইডির পক্ষ থেকে বলা হয়, সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। সংস্কারের অংশ হিসেবে বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের কাজ এগিয়ে চলেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, ব্যাংক কোম্পানি সংশোধন আইন, ২০২২, বাংলাদেশ ব্যাংক সংশোধন আইন, ২০২২, দেউলিয়া বিষয়ক (সংশোধন) আইন, ২০২২, পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেম আইন, ২০২২, সুরক্ষিত লেনদেন (অস্থাবর সম্পত্তি ) আইন, ২০২২, জাল-মুদ্রা প্রতিরোধ আইন, ২০২২, ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন, ২০২২, ব্যাংক আমানত (বীমা) আইন, ২০২২ অন্যতম। এই আইনগুলো কী অবস্থায় রয়েছে তাও জানতে চায় আইএমএফ প্রতিনিধিরা। এর জবাবে বলা হয়, বেশ কয়েটি আইন সংসদে পাঠানো হয়েছে। বাকিগুলো চলতি বছরের মধ্যেই সংসদে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
সভায় আইএমএফের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এফআইডির পক্ষ থেকে এ সময় বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের ওপর অর্থ মন্ত্রণালয় কোনো হস্তক্ষেপ করে না। এগুলো ছাড়াও আইএমএফের পক্ষ থেকে ব্যাংকের বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় বলে সূত্র জানায়।