অমরাবতির অন্যতম প্রধান এডভাইজার ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আলহাজ্ব আব্দুল মালিক পারভেজ শুধুমাত্র যে বাগান প্রেমিক তা নয়।একাধিক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ,লেখক সাংবাদিক, সংগঠক ও মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব। এত কিছুর পর ও তিনি যে একজন বাগান বিলাসী তার প্রমাণ পাওয়া যায় বার্মিংহামস্হ এক্সেস গ্রীনের বাসার সামন ,ও পিছনের বাসা দেখলে। তাই আসুন আজকের অমরাবতির গল্পের মধ্যমে জেনে নেই কি আছে আলহাজ্ব আব্দুল মালিক পারভেজ সাহেবের বাগান বিলাসের গল্পে।
ছোটবেলা থেকেই গাছ ও ফুলের প্রতি আমি আকৃষ্ট থাকলেও আমার মূলতঃ ফুল বাগানের দিকে বেশী আকর্ষণ বেশী ছিল। আমার পিতা মরহুম ডাক্তার আব্দুল মতিন সাহেব ছিলেন একজন সরকারী কর্মকর্তা। বিভিন্ন থানায় মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চাকুরীর নিয়ম মাফিক কয়েক বছর পর পর অন্য হাসপাতালে বদলি হতে হত ।আমার বয়স যখন ৫/৬ বছর তখন তিনি বালাগন্জ থানার একটি হাসপাতালে বদলি হন ।সেখানে বাসার সামনে অনেক বড় জায়গা এবং পিছনে ও বিরাট খালি জায়গা বাসার চার দিকে আম,কাঠাল, বড়ই, আতাফল,নারিকেল, সুপারী ও পেঁপের গাছ সহ কিছু বাঁশ ঝাড় ও ছিল। বাসা এবং হাসপাতালের সামনে বিরাট সরকারী দীঘি এবং বাসার পিছনে ছোট আরেকটা পুকুর। সব মিলিয়ে অপূর্ব এক প্রাকৃতিক পরিবেশ ।বাসার সামনের বাগানটি ফুল বাগান থাকলে পরিচর্যার অভাবে খুবই খারাপ অবস্থা ছিল। সেখানে যাওয়ার পর আমার মাথার মধ্যে একটি চিন্তা কাজ করতে লাগলো কিভাবে এই বাগানটি একটি সুন্দর বাগানে পরিনত করা যায় ।চিন্তা মোতাবেক প্রানিংটা আব্বার কাছে পেশ করলাম। আব্বা সম্মতিতে খুশি হলাম।ভাবলাম কঁচিমনের সেই আবদারটা সেদিন আল্লাহতালা হয়তো কবুল করে নিয়েছিলেন। আমাদের লেখাপড়ার সুবিধার জন্য আব্বা স্হানীয় স্কুলের একজন শিক্ষককে আমাদের বাসায় থাকা খাওয়ার জায়গা করে দিলেন।আর সেই শ্রদ্ধেয় স্যার যখন জানতে পারলেন আমি ফুল খুব ভালোবাসি এবং ফুল বাগান করতে আগ্রহী তখন তিনি আমাকে সবচেয়ে বেশী সাহায্যে করলেন। কারণ তিনি নিজেই একজন বাগান বিলাসী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে ফুলের চারা ও বীজ এনে কয়েক মাসের মধ্যেই আমাদের বাগানটি মন জুড়ানো একটি সুন্দর ফুল বাগানে পরিনত করলেন ।এখানে একটি কথা বলা বাহুল্য যে, বাগান করা যদিও একটি মহৎ কাজ, তবে বাগানের পরিচর্যা করা চাট্রখানি কথা নয়।আমি যে বয়সে বাগানের পরিচর্যায় মেতে থাকতাম সে,সময় আমার বয়সের ছেলেরা মাঠে থাকতো বল নিয়ে।আমার প্রতিদিনের রুটিন ছিল স্কুল থেকে বাসায় এসে খাওয়ার দাওয়ার পর ফুল বাগান নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম ।তবে আমার শ্রদ্ধেয় স্যারের সহযোগিতা ও সাহায্যে ছাড়া সে সময়ের বাগান করার স্বপ্ন হয়তো অপূর্ণ থাকতো।আমার যতটুকু মনে পড়ে একদিন একটি গরু পুরাতন বেড়া ভেঙ্গে অনেক ফুল গাছ নষ্ট করে। তখন আমার কান্না ভেজা দুংখ ভারাক্রান্ত মনের করুন অবস্হা দেখে আব্বা সাথে সাথে অনেক টাকা খরচ করে মজবুত বেড়া তৈরী করে দিয়েছিলেন।
অতপর আব্বা যখন বুঝলেন ফুল বাগানের জন্য আমি ও আমার স্যার যথেষ্ট। তখন আব্বা আম্মা বাসার কাজের লোক ও হাসপাতালের কেয়ার টেকারকে নিয়ে পিছনের বাগানে সব্জি চাষে ব্যস্ত থাকতেন। এতে করে প্রচুর পরিমাণে লাউ,সীম (উরি),বেগুন, মূলা,আলু টমেটো ডাটা,লাইশাক,ধনিয়া পাতা সহ অনেক কিছুরই বাম্পার ফলন হতো।যা দিয়ে আমাদের সব্জির চাহিদা যেমন মিটতো তেমনি অতিরিক্ত সব্জি আব্বা পাড়া প্রতিবেশী সহ আত্মীয় স্বজনদের বিলিয়ে দিতেন। আমার আব্বা আম্মা শুধু সৌখিন বাগানী ছিলেন না তাদেঁর খামারের ও শখ ছিল।পারিবারিক খামার, যা কিছুটা এখানে উল্লেখ করা দরকার মনে করছি।আব্বা আম্মা হাস, মুরগি,গাভী, কবুতর এগুলো পালন করতেন। পাখি পালন করা ও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমার আব্দার রক্ষার্থে একবার আব্বা অনেক দাম দিয়ে সুন্দর একটি ময়না পাখি আমার জন্য কিনে এনেছিলেন। এই ময়না পাখিটি আমাদের ভাই বোনদের নাম ধরে ডাকতো।আব্বার আবার পাখি শিকারের শখ ছিল। সৌখিন পাখি শিখারী হিসেবে তিনি বন্দুক নিয়ে এক হাওর থেকে অন্য হাওরে শিকারের জন্য যেতেন।একবার একটি হাওর থেকে সরালী হাঁসের কয়েকটা বাঁচ্ছা এনে পালতে লাগলেন। এই বাচ্চাগুলো থেকে বংশ বিস্তার করে ১০/১২টি হাঁসের একটি ঝাঁক সারাদিন আশপাশের বাড়ির পুকুর, ডোবা,বিল ইত্যাদিতে উড়ে বেড়াতো আবার সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরতো।এলাকার লোকজন জানতো এই হাঁসগুলো আমাদের,তাই কেউ এগুলোকে শিকারের চেষ্টা করতো না। এভাবে প্রায় ৮ বছর চলে গেল ।আবারো আব্বার বদলির সংবাদ। সবাই খুশি যাতায়াত ব্যবস্হা যেমন ভালো, তেমনি ভালো স্কুল ও রয়েছে।সংবাদটি সবার জন্য খুবই খুশির হলেও আমার জন্য তা ছিল খুবই দুঃসংবাদ ।নিজ হাতের তৈরী বাগান ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে আমি অনেকটা ভেঙ্গে পড়ি।সবার খুশির সাথে আমার এই দুংখটাকে কারো কাছে প্রকাশ না করে একা একা চোখের জল ফেলে নিরবে সহ্য করেছি।সেদিনের কথাগুলো মনে পড়লে আজো মনে পীড়া দেয়।
নতুন জায়গায় এসে আবার ও ফুল বাগান লাগানোর চেষ্টা চালাই।তবে আগের বাগানের মতো এতো বড় জায়গা না থাকায় ছোট আকারে একটি বাগান গড়ে উঠেছিল। কিন্ত দুংখজনক হলে সত্যিই যে, ঐ সময়টা বাগানের উপযোগী সময় ছিল না।তখন ছিল বাঙালী জাতির জন্য একটি বেদনাময় ও গৌরবময় অধ্যায় ১৯৭১ সাল ।মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর ভয়ে দুইবার আব্বা আমাদের নিয়ে অন্যত্র আত্মগোপন করতে হয়েছিল নিরাপত্তার জন্য। কারণ আব্বা আহত মুক্তিবাহিনীর চিকিৎসা সেবা করায়, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী পাক সেনাদের কাছে আব্বার নামে রিপোর্ট করেছিল তাই।আর এই সুযোগে (আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে) পাড়ার গরু-ছাগলরা ফুল বাগান নষ্ট করে দিল এবং সেই সাথে কিছু কিছু গাছ চুরি হয়ে গেল।পরবর্তীতে যখন আবারো আব্বার বদলির ডাক আসে তখন আমি সিলেট এম,সি, কলেজের ছাত্র। এদিকে আব্বা আগেই সিলেটের শিবগঞ্জ এলাকায় জায়গা কিনে আমাদের লেখাপড়ার জন্য বাসা নির্মাণ করেন। এখন আর বদলির ঝামেলা না থাকায় বাসার সামনের জায়গায় ইচ্ছামত ফুলের বাগান করলাম। কিন্ত সমস্যা হলো বাসার পিছনে সমান্য জায়গা থাকায় সেখানে পর্যাপ্ত সব্জি চাষ করা সম্ভব হত না ফলে আম্মা সামনের ফুল বাগানে একটু জায়গা খালি দেখলেই সেখানেই লাউ, টমেটো ও উরীর (সীম) চাঁরা রোপন করতেন। এগুলো বড় হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে আমার ফুল বাগানের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যেত।মা দুংখ পাবেন বলে কিছু বলতাম না তবে তা মেনে নিতে কষ্ট ছিল। তাই কৌশল করে লাম্বা ছুরি দিয়ে মাটির নীচে যতটুকু সম্ভব ততটুকু গভীরে গিয়ে জড় কেটে দিতাম। ভাবতাম মা কি আমার দুষ্টুমি বুঝতে পারবেন। মা কিন্ত ঠিকই বুঝতেন, হয়তো আমার প্রচন্ড শখের দিকে তাকিয়ে আমাকে কিছু বলেননি।এ সব দুষ্ঠুমির কথা মনে পড়লে আজও নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়।তবে আমার ফুল বাগানটি খুব সুন্দর ছিল এবং সাজিয়ে ছিলাম নিজের মতো করে।আমার বাগানে বিভিন্ন রকমেরগোলাপ,জবা,সূর্ষমুখী ,হাসনা হেনা, গন্ধরাজ, বেলী, ডালিয়া,কসমস,পাতা বাহার সহ অনেক ধরনের ফুলের গাছ ছিল। গেইটের দুইধারে হাসনা হেনার বড় বড় দুটি গাছ থাকায় ফুলের সুভাসে সমস্ত এলাকা মুখরিত হয়ে উঠতো,তবে পর পর কয়েক বার ফুলের খুসবো পেয়ে বড় আকারের বিষাক্ত সাপ আসতে শুরু করলে ভাই বোনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।সবাই এতই আতংকিত হলো যে, আব্বা অবশেষে বাধ্য হয়ে হাসনা হেনার গাছগুলো কেটে ফেললেন।তাছাড়া পূজার সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা গভীর রাতে ফুল নিয়ে যায় বলে ঐ সময় কয়েক রাত ফুল বাগান পাহারা দিতে হতো ।তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা এসে যখন আমাকে আব্দার করতো ফুলের জন্য, তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের হাতে ফুল ছিড়ে তাদেঁর দিতে হতো পূজার জন্য।
সময়ের ধারাবাহিকতা এবং সময়ের তাগিদে এক সময় ইংল্যান্ডে বসবাস। এখানে প্রথম ঘরটি কেনা হয়েছিল ইংল্যান্ডের নর্থহাম্পটন শহরে,টেরেস হাউস।এই জাতীয় হাউসে বাগান করার মতো কোন জায়গা থাকে না।আমার ঘরের সামনে কোন জায়গা ছিল না, তবে পিছনে যে জায়গাটি কংকিটের মধ্যে স্লাভ দিয়ে ঢাকা।ফুল গাছ বিহীন বাসা এটাকে কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না,তাই কিছু স্লাভ তুলে গোলাপের গাছ লাগিয়ে ছিলাম।ইহা অনেকটা দুধের স্বাদ পানিতে মিটানো ছাড়া আর কিছু নয় ।বাগান করার পূর্ণ বাসনা থেকে ঘর খুঁজতে থাকি যে ঘরের সামনে পিছনে বাগান করা যায়।অতঃপর আল্লাহতালার অশেষ রহমতে নর্থহাম্পটন থেকে বার্মিংহামে চলে আছি।অবশেষে বার্মিংহামের Acocks Green এ যে বাসাটি ক্রয় করলাম তাতে সামনে ৭/৮টি গাড়ি রাখার জায়গা এবং পিছনে কিছু জায়গা।আমরা সামনে ৪টা গাড়ির জায়গা রেখে বাকি জায়গাগুলোতে ফুলের বাগান গড়ে তুললাম। এই বাগান গড়ে তুলতে আমি ও আমার স্ত্রী শেফা মালিক মিলে
প্রথমেই বাগানের মধ্যখানে যে স্পট দৃশ্যমান ছিল,তার উপর ভিত্তি করে আমরা ছোট ছোট চাঁরা থেকে ঐ আলোকে একটি ডিজাইন তৈরী করেছিলাম। যে ডিজাইন করতে প্রায় আট বছর লেগেছিল,যা দেখতে একটা অত্যাধুনিক বাগানে পরিনত হয়েছিল। পরবর্তীতে আমার ডিজাইনের বাগানটি ইউ, কে,এর একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলের গার্ডেন প্রোগামে বেশ কয়েক বছর দেখানো হয়েছিল এবং চ্যানেল এস এর গার্ডেন প্রোগামে আমার বাগানটি বেশ কয়েকবার দেখানো হয়েছিল। তাছাড়া বিগত দুই/তিন বছর ধরে অমরাবতির বাগান প্রতিযোগিতায় ফুল বাগানের সেরা ছবি হিসেবে পরপর দুই বার চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব বয়ে আনে।ফুল বাগানের সাথে সাথে সব্জি বাগান করার শখ ছিল কিন্ত বাসার পিছনে জায়গা বড় না থাকায় শুধু ফুলের গাছই লাগানো হয়েছে।দেশে বাগানের কাজের জন্য অনেক লোক পাওয়া যায় কিন্ত এখানে সব কিছু নিজেই করতে হয়।আমার স্ত্রী পেশায় একজন শিক্ষিকা।বাগানের প্রতি বেশ আকর্ষণ রয়েছে তবে ব্যস্ততার জন্য তেমন সময় দিতে পারেন না।ছেলেমেয়েদের কেন জানি বাগানের দিকে তেমন কোন আকর্ষণ নাই। কাজেই বাগানের সব কাজ আমাকেই করতে হয়।বৃদ্ধ বয়সে কষ্ট হলেও সখের তাড়নায় যতটুকু পারি বাগান করার চেষ্টা করি ।।