‘অমরাবতি’ একটি নাম, একটি ঠিকানা।এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না অমরাবতি বলতেই মানুষ বাগান বিলাসীদের বুঝে,বৃক্ষ প্রেমিকদের বুঝে,পরিবেশ বাদীদের বুঝে।কারণ অমরাবতিতে কবি, সাহিত্যিক,থেকে শুরু করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার , এডভোকেট ,অধ্যক্ষ, অধ্যাপক,ব্যারিস্টার, ক্রিকেটার ,ফুটবল, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন। এদের বাগান প্রেম বলেন, বা বাগান বিলাস বলেন,তাতেই রয়েছে অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতিচারণ মূলক গল্প।খন্ড খন্ড এই সব গল্প দিয়েই অমরাবতির গল্পের শুরু। এরকম একজন বাগান প্রেমিক ও পরিবেশ বাদী হচ্ছেন, কবি, শিক্ষাবিদ, ‘গোবিন্দগন্জ আব্দুল হক স্মতি কলেজ’ এর সহকারী অধ্যাপিকা জান্নাত আর খান পান্না।নামটিকে ব্যাকেট বন্দী করলে হয় পান্না জান্নাত।আসুন জেনে নেই কি রয়েছে
অমরাবতিয়ান পান্না জান্নাত এর গল্পে।
আমার শৈশব কেটেছে সিলেটের সুবিদ বাজারে আমার জন্মস্থান পিত্রালয়ে।আমাদের বাসাটি ৬০ এর দশকের তৈরি একটি টিনশেড ঘর ছিল। সামনে ও পিছনে মাটির উঠোন। ঘরের সামনে একটি সরু খাল রয়েছে যেটি আমাদের সীমানা প্রাচীরের ভিতরেই।আমার যখন বুঝার বয়স হয়েছে তখন থেকেই দেখে আসছি আমাদের ঘরের সামনের উঠোনে একটি ফুলের বাগান ছিল। বাগান বলতে বাঁশের তৈরি প্রাচীর ঘেরা কয়েকটি অপরিকল্পিত ফুলের গাছ।এখানে যেমন রয়েছে হাস্নাহেনা, কামিনী কাঞ্চন, সাদা মালতী,সন্ধ্যা মালতী ফুলের গাছ, তেমনি রয়েছে গোলাপফুল, রক্তজবা ফুল আবার বিভিন্ন রকমের পাতাবাহারের গাছ।বাগানের বাইরে ও বাসায় ঢুকার গলির দুই পাশে লাগানো ছিল হরেক রকম পাতা বাহারের গাছ।রাতের বেলা হাস্নাহেনার সৌরভে আমাদের বাসার পথের(গলির) শুরু অব্দি মৌ মৌ করত। বাগানের পাশে আমাদের সদর দরজার সামনে একটি অলকানন্দা গাছ অনেক বৎসর যেন বাসাটির পাহারাদারের ন্যায় চৌদিকে বিদ্যুুৎ বাতির মতো অসংখ্য হলুদ ফুল ফুটিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। এর পাশেই একটা কাঠমালতী গাছ ছিল যেটি পুরো বৎসর সাদা ছোট ছোট ফুলে ভরে থাকতো। তখন আমাদের পরিবারের সদস্যরা ফুল পছন্দ করতেন, গাছ এনে লাগাতেন,পরিচর্যা করতেন কিন্তু অনেক ফুলেরই নাম জানতেন না। যেমন অলকানন্দাকে আমরা হলুদফুল( কেউ কেউ মাইকফুল) এবং কাঠমালতীকে দুধফুল বলতাম।আমাদের বাসায় একটি ক্যকটাস গাছ ও ছিল যেটাকে আম্মা ঔষধি গাছ হিসেবে ব্যবহার করতেন। কারো কাশি হলে এটার শাখা ভেঙে রস খাওয়ালে কমে যেত।আমাদের বাসায় একটি স্থলপদ্ম ফুলের গাছ ও ছিল। এই গাছটির একটি গল্প রয়েছে, যে গল্পটি আম্মার মুখে অসংখ্য বার শুনেছি। কিশোরী বয়সে আমার রাঙাআপা ছিলেন একটু দুরন্ত প্রকৃতির।আম্মার সাথে কোথায় জানি রিকশায় চড়ে যাচ্ছিলেন।হঠাৎ উনি রিকশা থেকে লাফ দিয়ে উপরের দিকে উঠে একটি গাছের মগডালটি ভেঙে আবার রিকশায় পড়ে যান।সেই মগডালটি ছিল পরবর্তীতে আমাদের বাসার পূর্ণাঙ্গ স্থলপদ্মের গাছটি।
আমার আব্বা ও আম্মার হাতে লাগানো অনেক গুলো ফলের গাছ ও ছিল বাসায়।আম,কাঠাল,জাম,আতাফল সহ অনেকগুলো তুঁতফলের গাছ ছিল। আম, কাঠাল, খুব বেশি না হলেও,তুঁতফল হত খুব বেশি। গাছের শাখায় ঝুলে থাকত টকটকে লাল তুঁতফল, গাছের নীচে পড়ে যেত পরিপক্ব কালো তুঁতফল।পড়ে ফেটে গিয়ে লালরসে লাল হয়ে যেত আমাদের মাটির উঠুন যেন কোন জলজ্যান্ত মানুষ গাছ থেকে পড়ে রক্তাক্ত হয়েছে ।আমরা নিজেরা খেতে খেতে পাড়া প্রতিবেশীকে বিলিয়েও শেষ করতে পারতাম না।
আমাদের রান্না ঘরের গা ঘেঁষে ছিল বরই গাছ।গাছটির শাখা প্রশাখা সব উপুড় হয়ে পড়েছিল রান্না ঘরের চালের উপর। বাতাসে, পাখির ঠুকরে বা বাচ্চাদের ঢিলে পাকা বরই টুপ টাপ করে পড়ত টিনের উপর। আব্বা অনেক গুলো কলাগাছ লাগাতেন প্রতিবৎসর।আবার বৎসরান্তে গাছ কেটে ভিতরের সাদা অংশ( যাকে আনাজ বলা হয়) নিয়ে আম্মা অতি মুখরোচক সব্জি রান্না করতেন।এছাড়া ও আমার আম্মা শীতকালীন সব্জি চাষ করতেন মহাসমারোহে। শীত আসার আগেই আব্বা দিন মজুর ঠিক করে সাথে নিজেও সমস্ত দিন থেকে ঘাস কাটিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে সামনের পিছনের জায়গা গুলোকে সব্জি চাষের উপযুক্ত করে তুলতেন।এরপর আম্মা শীম,লাউ,প্রভৃতির বীজ বপন করতেন। আবার অনেক জমি জুড়ে ধনেপাতা,পিঁয়াজ পাতার ও চাষ করতেন। শিম,লাউ তেমন একটা না খেলেও নিজস্ব ক্ষেতের প্রচুর ধরে,পিঁয়াজপাতা খেতে পারতুম।
আমাদের বসার ঘরের সদর দরজার পাশেই একটা তেজপাত গাছ ছিল। আমাদের বাসার পরিচয় দিতে এ গাছটি বিশেষ সহায়কের ভুমিকা পালন করত। এছাড়া আমাদের বাসার পিছনে ও সামনে কয়েকটি বাঁশবাগান ছিল। এগুলোকে আমরা বাঁশঝার বলতাম।ভরাপূর্ণিমার রাতে আমাদের ঘরের সামনের বিদ্যুৎবাতির আলো নিভিয়ে উঠোনে আমরা ভাইবোনরা মাদুর পেতে বসে বাঁশ বাগানের মাথার উপর সোনালি থালার মতো চাঁদের ছড়ানো মায়াবী আলোয় মধ্যরজনী পর্যন্থ আড্ডা দিতাম।এছাড়া ও আমাদের বাসায় অনেকগুলো সুপারিগাছ ছিল। শীতকালে এ গাছগুলোতে নীচের অংশে সাদা চুনাজল দিয়ে রং করা হত।বাসায় ঢুকার পথের শুরুতে বাসাটিকে অপূর্ব সুন্দর লাগত।মনে হয় কবি নজরুল ‘ বাতায়ন পাশে গোবাক তরুর সারি ‘ কবিতাটি যেন আমাদের বাসা দেখেই লিখেছিলেন।
বর্তমানের সামনে খালি জায়গা সম্বলিত অধুনা বাসাগুলোতে অনেক সুপরিকল্পিত, সুবিন্যস্ত বাগান দেখতে পাওয়া যায়।আমাদের আম্মা আব্বার সেকেলে বাসায় কিছুটা পরিকল্পিত হলেও অধিকাংশ ছিল অপরিকল্পিত,অবিন্যস্ত অনেকটা আপনা আপনি গজিয়ে ওঠা বৃক্ষ লতায় আমাদের বাসাটি ছিল, “গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়।”।
সেই পল্লনঘন ছায়াবীথি তলে আজন্ম বেড়ে উঠা মানুষ আমি। আমার মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা বৃক্ষ প্রেম বা সবুজ কিশলয়ের প্রতি যে সুপ্ত ভালোবাসা ব্যস্ততম যান্ত্রিক জীবনের বাস্তবতায় চাপা পড়ে থাকলেও সর্বদা আমার মন ছিল উতলা। যেখানেই দেখি সবুজের সমারোহ সেখানেই নিজেকে বিলিয়ে দিতে সাধ জাগে। বৃক্ষ বিহীন মরু প্রান্তর এ কর্মময় জীবনে আমি যেন হাঁফিয়েউঠছিলাম।
” হেথা নয়,হেথা নয়,অন্য কোথা
অন্য কোনখানে” যেন আমি খুঁজে ফিরি সারাক্ষণ।
আমার বিবাহোত্তর জীবনে ভাড়া বাসার বারান্দায় টবে অনেক রকমের গোলাপ, জিনিয়া,পাথরকুঁচি, পাতা বাহার গাছ লাগিয়েছিলাম ২০১০/১১ র দিকে। কিন্তু সংসার,সন্তান ,চাকরি সব সামলিয়ে গাছের যত্ন করা হয়ে উঠলো না আমার।বিধায় অনাদরে অবহেলায় যা হবার তাই হলো।আমার কলেজে প্রচুর জায়গা থাকায় ২০১৩ সালে আমার উদ্যোগে অধ্যক্ষ মহোদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় প্রশাসনিক ভবনের সামনে একটি বাগান করি যেখানে, ডালিয়া, গাদা,জিনিয়া অনেকগুলো মৌসুমি ফুলের সাথে বাগানের ঠিক মাঝখানে একটি ক্রিসমাসট্রি ও রোপণ করি।বাগানের অন্যান্য ফুলগাছ গুলো বছর বছর বদল হলেও সেই আমার হাতের লাগানো ক্রিসমাসট্রি টি এই বাগানের উদ্যোক্তা যে আমি ছিলাম সেই সাক্ষ্য বহন করছে আজো,হয়তো করে যাবে সেদিন ও “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।”
শেষমেষ এসে অমরাবতীর
” শ্যামলও সুন্দর ও রূপটি আমি যেদিন হতে হেরি গো,
আমার পাগল মনে না লয় ঘর বাড়ি। ”
বন্ধু শিমু (ডাঃ খূর্শিদা তাহমিন) আমাকে ফোন করে জানায় যে আমার কলেজে কিছু গাছ দিতে চায় ‘অমরাবতী’ নামক একটি সংগঠন থেকে। আমি তো স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি জানাই।এরপর সেবুল চৌধুরী ভাই ইংল্যান্ড থেকে আমার ম্যাসেঞ্জারে কল দিয়ে আমার সাথে পরিচয় পর্বটা সেরে ফেলেন এবং আমার কলেজে বৃক্ষ দানের প্রস্তাবটি আরো জোড়ালো করেন।সেই সাথে তিনি আমাকে অমরাবতীতে সম্পৃক্ত হবার প্রস্তাব দেন।আমি মুগ্ধ হই।আমার কলেজে গাছ দেবেন কোথায় আমি দাবি জানাবো,তার চেয়ে উনি তাড়না দিচ্ছেন আমাকে।এ যেন গ্রহীতার চেয়ে দাতার আগ্রহই বেশি। এই না হলে প্রকৃত বৃক্ষ প্রেমিক,দেশপ্রেমিক। যিনি দীর্ঘ দিন প্রবাসে থেকে ও পাউন্ডের টাওয়ার তৈরির নেশায় মত্ত না হয়ে বা সেখানকার কোন ক্ষমতাবান প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ার স্বপ্ন না দেখে স্বপ্ন দেখেন নিজের দেশমাতৃকাকে নিয়ে। স্বদেশের হারিয়ে যাওয়া সোনালী অতীত, প্রকৃতির লীলাভূমি,হারিয়ে যাওয়া নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া “ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলি” ফিরিয়ে আনার জন্য যেন আত্মনিমগ্ন।
এক ফাঁকে আমার বন্ধু শিমু আমাকে সদস্য ও করে নেয় অমরাবতির।মনের টানে সুপ্ত প্রেমে নিজের অজান্তেই জড়িয়ে যাই সবুজ বিপ্লবের আন্দোলনে।
এতপর অমরাবতির একটি গেটটুগেদার হয় কাবাবিয়া রেস্টুরেন্টে। যেখানে আমি প্রথম সশরীরে উপস্থিত হই। পরিচয় হয় আরো অনেক স্বনামধন্য, সুপরিচিত বৃক্ষ প্রেমিকের সাথে। দেশে আসেন সেবুল চৌধুরী ।অমরাবতীর একটি বিরাট মিলনমেলা হয় হোটেল মীরা গার্ডেনে ।আমি প্রথম উনাকে স্বচক্ষে দেখি এবং উনার বক্তব্য শুনে আপ্লুত হই।প্রবাসে থেকে ও যাদের হৃদয়ে প্রতিনিয়ত ঝংকৃত হয় ‘বাংলাদেশ আমার প্রিয় বাংলাদেশ ‘,জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে জীবনের অধিকাংশ সময় দেশ থেকে অনেক দূরে থেকে ও স্বদেশের মাটির সোঁধা গন্ধে যাদের মন ভরে থাকে সেবুল চৌধুরী তাদেরই একজন। অমরাবতীর উদ্যোগে এপ্রিল মাসে একটি (সালুটিকর) বধ্যভূমিতে বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করি অমরাবতীর একজন গর্বিত সদস্য হিসেবে। ভিষণ ভালো লাগছিল নিজেকে অমরাবতীতে খুঁজে পেয়ে।আমি যেন ফিরে পেলাম, “মোর পূর্ব জনমের প্রথামা প্রিয়ারে।”
হাঁটি হাঁটি পা পা করে বাংলার পথে প্রান্তরে,অলিতে-গলিতে, শিক্ষাঙ্গনে, হাসপাতালে, বধ্যভুমিতে বৃক্ষ রোপণ করে করে প্রিয় জেলা সিলেট তথা প্রিয় স্বদেশ একদা হয়ে উঠবে সবুজে সবুজময়। সবুজ বিপ্লব ঘটিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিতে আমরা “সৃজিব অমরাবতী ” এই প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাব।আমি অমরাবতীর কর্ণধার সেবুল চৌধুরীসহ এর সকল বৃক্ষ প্রেমিকের দীর্ঘায়ু ও অমরাবতির উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি। অমরাবতি চিরজীবী হোক।