অমরাবতির গল্প মানেই যে বাগানের গল্প, ফল ফুলের গল্প শুধু তা নয়।অমরাবতি গল্পের সাথে সংযুক্ত রয়েছে পরিবেশের গল্প,বৃক্ষ রোপনের গল্প, মানবাধিকারের গল্প। ‘অমরাবতি’ যদি কোন শিল্প হয়ে থাকে, সেই শিল্পের নিখুঁত শিল্পীরা হচ্ছেন দেশে -বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল অমরাবতিয়ানরা ।এ রকম একজন শিল্পী হচ্ছেন লন্ডনের উডগ্রীণে বসবাসরত অমরাবতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং অন্যতম বোর্ড অফ ডাইরেক্টর খালেদা রওশন (রওশন পলাশ) ।আসুন জেনে নেই কি রয়েছে এই শিল্পীর তুলিতে।
আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা সিলেট শহরের সবুজ প্রেমি এক যৌথ পরিবারে।তাই সহজাত ভাবেই সবুজের প্রতি আমারও আগ্রহ,ভালবাসা নিজের অজান্তেই ছিল সেই ছোট বেলা থেকে।আমার দাদা, দাদী,নানা,বাবা, মা, চাচা,ফুফুরা সবাই নানারকম ফল ফুলের গাছ লাগাতেন, যত্ন নিতেন।এখনও গাছের বীচি লাগাতে গেলে ছোট বেলার একটা মধুর স্মৃতি মনে পড়ে।একদিন বিকেলে দেখি, আমার দাদী সুপারী গাছের খোলে লাই শাকের বীচি,ছাই আর ডি,ডি,টি মিশিয়ে তৈরী মাটির উপরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আমিও দিতে চাইলাম। বললেন এগুলো বিষ, না ছুঁতে।পিপড়া,পোকা মাকড় যাতে বীচি না খায় তাই এই পন্থা।এখন জানি ডি,ডি, টি কত বিষাক্ত।আমার আব্বার (প্রয়াত) ফুল প্রীতি ছিল বেশী। বিশেষ করে সাদা সুগন্ধি ফুলের প্রতি।তাই ঘরের চারপাশে বেলী, কামিনী, হাসনাহেনা, গন্ধরাজ, সাদা গোলাপের গাছ লাগিয়েছিলেন।এগুলোর ফুল ফুটলে রাতের বেলায় চমৎকার মৌ,মৌ ঘ্রানে মেশানো পরিবেশ তৈরী হতো।এছাড়াও পুকুর পারে স্থলপদ্ম (Hibiscus mutabilis),কাঁঠাল চাঁপা, দাদীর লাগানো গাছে শেফালী ফুলের গন্ধে ভরে থাকত।শরতের ভোরে শেফালী ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথা, এখনও স্মৃতিতে আনাগোনা করে।বারান্দার ধার ঘেসে আব্বার অতি পছন্দের ঘাসফুলগুলো বৃষ্টির সময়ে হাসতে থাকতো।আব্বার পরে আমিও এই ধারা ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। সাথে বাসার ছোট বড় সদস্যরাও ছিলেন।আমাদের বাসায় অনেক রকমের ফলের গাছ ও ছিল।আমার অগ্রজদের হাতের লাগানো অনেকগুলো গাছ এখনও তাদের মমতার ছোঁয়া বহন করে চলছে।
জীবনের পথ পরিক্রমায় এক সময় ‘সাত সাগর আর তের নদী’ পাড়ি দিয়ে বিলেতে আসি।সাথে ছিল আমার সবুজ প্রীতি, ফুলের প্রতি প্রাণের টান।এখানেও দেখলাম আমার স্বজনদের বাগান ফুলে -ফলে শোভিত।আমিও শুরু করলাম।যে বাড়ীটিতে এখন আছি, কাকতালীয় ভাবে ঐ বাড়ীর মালিকের ও ফুল প্রীতি ছিল।বাড়ীর সাথে সাথে ফুলের গাছগুলোও পেয়ে গেলাম। যার অধিকাংশই ছিল গোলাপ ফুল।গোলাপ আমার অন্যতম প্রিয় ফুল । বাড়ীর সাথে পাওয়া বোনাস গোলাপ ফুল গুলো এখনও হাসে।একদিন হঠাৎ করেই একটা দোকানে গন্ধরাজ ফুলের গাছ দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। নিয়ে আসলাম সাথে করে।যেন আমার আব্বার ভালবাসা নিয়ে এসেছি। বার বার এসে ফুলের গন্ধ শুকতাম,মনে হতো আব্বা আমার পাশেই আছেন। কিন্ত হয়তো অতি আদরেই গাছটি টিকলনা বেশি দিন। তার পর থেকেই প্রতি বছর অন্যান্য ফুলের সাথে গন্ধরাজ ফুলের গাছ নিয়ে আসি।ক্ষণে ক্ষণে যেয়ে দেখি,কখনও জোরে,কখনও ফিসফিস করে ওদের সাথে কথা বলি, আদর করে ছুঁয়ে দেই। “গাছের, ও প্রাণ আছে”, তাই না। সবগুলো গাছের সাথেই আমার সখ্যতা। দেশে থেকে এনে ঘাসফুল ও লাগালাম। খুব ভাল লাগে সাথে যখন এদের সাথে থাকি।আমার ছোট্ট বাগানে ফুলের আধিক্যই বেশী।ফুলেরা যখন হাসতে শুরু করে,মনটা অনাবিল আনন্দে ভরে যায়।নিজের অজান্তেই হাসি, কথা বলি, মেয়েদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করি। চেষ্টা করি আমার অনুজদের ও সবুজের সাথে মিতালী করিয়ে দিতে। নানা ভাবে উৎসাহিত করি।প্রিয় সংগঠন ‘অমরাবতি’র পাতায় সদস্যদের সাথে নিয়ে আমার আনন্দ ভাগাভাগি করি। বাগান পরিচর্যা আমি নিজে করতে ভালবাসি।মেয়েদের ও ডেকে আনি পরামর্শ দেয়ার জন্য। বাগান করা, গাছ পালা যত্ন নেয়া বেশ শারিরীক পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু আমি মনে করি এটা মনকে প্রফুল্ল করে।দৈনন্দিন জীবনের অনেক সমস্যা থেকে মনকে কিছু সময়ের জন্য হলেও দূরে সরিয়ে রাখে।বাগানে সময় কাটানোটা খুব ভাল মেডিটেশন ও।
‘অমরাবতি’র জন্মলগ্ন থেকেই সাথে আছি। যখন বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ করা ও সেই সাথে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের অল্প হলেও পুষ্টিকর ফল খাবার সুযোগ করে দে’য়ার কথা ভেবে, ‘অমরাবতি’ প্রথমেই সিলেট থেকে বৃক্ষরোপন কার্যক্রমের সূচনা করলো।এই কাজটি শুরু করল অমরাবতিরসিলেট চাপ্টার ।তখন খুব আগ্রহ নিয়ে সব খবর নিতাম, বার বার ছবিগুলো দেখতাম।কল্পনায় ওদের সাথে আমিও থাকতাম।
গত শীতে যখন দেশে গেলাম, সেই কাঙ্খিত সুযোগটা সত্যিই এসে গেল। এস,ও,এস শিশু পল্লীতে সিলেটের অমরাবতিয়ানদের সাথে গেলাম বৃক্ষরোপন করতে।অন্যরকম অনুভূতিতে মন ভরে গেল। মনে হল আমিও আজ থেকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ‘সবুজ বিপ্লবের’ এক গর্বিত সৈনিক। দক্ষিণ সুরমা, লাক্কাতুরা ও আরও দুয়েকটা স্কুলে লাগানো গাছের বেড়ে ওঠা দেখে পুলকিত হলাম।
দেশে থাকাকালীন সময়ে সালুটিকর বধ্যভূমির ‘শহীদ স্মৃতি উদ্যান’ দেখতে গিয়ে মনে হল, এখানেও তো ‘অমরাবতি’ গাছ লাগাতে পারে। সিলেটের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে আগ্রহ প্রকাশ করার সাথে সাথেই শ্রদ্ধেয় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউদ্দীন আহমদ ভাই ও মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল সালাম ভাই বীর প্রতীক, সদয় সম্মতি জানান। কাল বিলম্ব না করেই, রমজান মাসে, চৈত্রের প্রখর রৌদ্র আর দাবদাহ উপেক্ষা করে সিলেটের ক’জন সদস্যদের নিয়ে পলাশ, শিমুল আর কৃষ্ণচুড়া রোপন করি শহীদ স্মৃতি উদ্যানের বাইরের দেয়ালের দিকে।এটা ছিল অনেক আবেগঘন একটা অভিজ্ঞতা।আমরা ‘সবুজ বিপ্লবের’ সৈনিকেরা, অমরাবতিয়ানরা এমন একটি জায়গায় বৃক্ষরোপন করলাম, যার সাথে আমাদের অস্তিত্বের সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে।যেখানকার মাটির প্রতিটি কণায় মিশে আছে আমাদের পরিচয়,আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের লাল সবুজের পতাকা সহ বেদনা বিধুর স্মৃতি।
সবশেষে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা ‘অমরাবতি’র স্বপ্নদ্রষ্টা সেবুল চৌধুরী সহ আমাদের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হোক।অমরাবতির হউক সবুজের সমারোহের এমন এক ক্যাফেলা যা বিশ্ব পরিবেশ বাদীদের জন্য একটি মাইল ফলক হয়ে থাকে।আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা যেন বাসযোগ্য সবুজ পৃথিবী রেখে যেতে পারি।আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকেই ছোটদের ও এ কাজে উৎসাহিত করি, অনুপ্রাণিত করি।বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে ‘অমরাবতি’র সবুজায়ন প্রকল্প সফলতা লাভ করুক।